১০ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার | বাংলা কনভার্টার
প্রয়োজন_সবুজায়ন !
ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যামে বসে থাকা এখন আমাদের জন্য একটা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোজার মাস শুরু হলে তা সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে। আজকাল রিকশায় বসে সামনে যতদূর চোখ যায় যানবাহনের থমকে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে আমার মাথার ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে যায়! দৃষ্টি শূন্য হয়ে যায়! আমি প্রায় সময় ভাবি আমরা কি এই রকম ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় যে যার বাহনে বসে বসে সময় কাটাবো? যে ভাবে শহরের উপর চাপ বাড়ছে, যেভাবে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে, যেভাবে চলাচলের রাস্তা কমছে তাতে আরো ২০/৩০ বছর পর আমরা কোথায় গিয়ে দাড়াবো? প্রাইভেট কার আরো সহজলভ্য হয়ে যাবে হয়তো আমাদের কাছে। তারপর? যে যার প্রাইভেট কার-এ বসে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তাতেই থাকবো?
তাপমাত্রা -- প্রতি বছর বাড়ছেই কেবল। অতিরিক্ত গরম আমাদের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে, ক্লান্ত করে ফেলছে আমাদের। আমরা যে সামান্য অংশ অফিসে বসি তাদের তবুও চলে যাচ্ছে কিন্তু যে বিশাল অংশ মাঠে-ঘাটে, রাস্তায় যে যার পেশা বা বৃত্তিতে নিয়োজিত তাদের কি হচ্ছে? তাদের কি হবে?
এবার আসুন একটু ভাবি! মনে করি এই পৃথিবীর কেবল দুইটি অংশ আছে। একটা পূর্ব আর একটা পশ্চিম। প্রকৃতিগত ভাবে পশ্চিম হচ্ছে শীতপ্রধান অঞ্চল আর পূর্ব হচ্ছে গরমের দেশ মানে আমরা যে অংশে আছি। পশ্চিমারা বরাবরই আমাদের চেয়ে এগিয়েছিলো। তারা যা দু'শ বছর আগে করেছে আমরা তা এখন করছি। খুব স্বভাবত কারণে আমরা তাদের অনুকরণ করে চলেছি। পশ্চিমাদের মত উন্নত হতে হবে আমাদের। বড় বড় বিল্ডিং, রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার নানাকিছুতে পরিপূর্ণ হয়ে উন্নত হয়ে উঠছে পূর্বের দেশগুলো। কিন্তু একবার ভাবুন প্রকৃতিগতভাবে তারা শীতপ্রধান অঞ্চলের হওয়ায় এই অতিরিক্ত উষ্ণ আবহাওয়া তাদের নিঃশেষ করছে না। কিন্তু আমরা প্রাকৃতিকভাবে গরমের দেশ হওয়ায় উন্নতির নামে যখন গাছপালা কমিয়ে ফেলেছি, রাস্তায় যানবাহন বাড়িয়ে ফেলেছি, কল-কারখানা বৃদ্ধি করে চলেছি তখন তার বিরুপ প্রভাব স্বাভাবিক কারণেই আমাদের বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। পশ্চিমারা আবহাওয়ার বিরুপ পরিবর্তনে আমাদের চেয়ে বেশি ভুমিকা রাখছে কিন্তু প্রাকৃতিক কারণে হিমালয়ের পাদদেশে হওয়ায় সেটার বিরুপ স্বীকারও আমরাই আগে হবো হয়তো। আমরা এখন এই ২০১৯ সালে যে বিরুপ উষ্ণ আবহাওয়ার মুখোমুখি হয়েছি তেমন অবস্থায় পড়তে পশ্চিমের দেশ গুলোর আরো শত শত বছর লাগবে। অথচ আমরা না বুঝেই একটা সাময়িক উন্নতির পেছনে বোকার মত ছুটছি। এই আমরাই যদি না থাকি তবে এই উন্নয়নের কি লাভ? উন্নতির অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেই উন্নতি যদি একসময় মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে দাড়ায় তবে তেমন উন্নয়নের আগে বহুবার ভাবা উচিত ছিলো। পশ্চিমাদের অনুকরনে স্ট্র্যাকচারাল ডেভেলপমেন্টর পরিবর্তে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে আমাদের পরিকল্পনা ভিন্ন হওয়া উচিত ছিলো।
এবার দেখা যাক যে আসলেই বিশ্ব পরিস্থিতি কেমন? ( তথ্যসুত্রঃ State of the World's forests 2007 produced by FAO) -- যা পেলাম
ইউরোপঃ
ইউরোপ sustainable forest management ডেভেলপ করে ফেলেছে। ইউরোপের দেশগুলোতে শুধু বনাঞ্চল বৃদ্ধি পাচ্ছে তা নয়, তাদের এই অর্জনে প্রতি বছর একটা পজিটিভ ট্রেন্ড লক্ষ্য করা যাচ্ছে। The Ministerial Conference on the Protection of Forests in Europe (MCPFE) বিশ্ব দরবারে বনায়ন ইস্যুটা সামনে তুলে ধরতে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক - আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।
আফ্রিকাঃ
১৯৯০-২০০৫ এ আফ্রিকা ফরেস্ট এরিয়া হারিয়েছে প্রায় ৯ শতাংশ। কিন্তু আফ্রিকার ফরেস্ট ইস্যু সর্বোচ্চ পলিটিক্যাল সাপোর্ট পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ ২০০০-২০০৫ সালে প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কাজে প্রাথমিকভাবে ব্যবহার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিলো যা কিনা চুড়ান্তভাবে ৭০ মিলিয়নে হেক্টরে উন্নীত করার পরিকল্পনা আছে।
উত্তর আমেরিকাঃ
কানাডা, মেক্সিকো এবং ইউ এস এ এই তিনটি দেশেই উল্লেখযোগ্য পরিমানে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রয়েছে। এর মধ্যে মেক্সিকোতে কিছু হ্রাস পেলেও কানাডা ও আমেরিকা প্রকৃত বনাঞ্চল এরিয়ায় স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে।
এশিয়াঃ
২০০০-২০০৫ এ এশিয়া প্যাশিফিক অঞ্চলে বনাঞল কিছুটা বাড়লেও এই বৃদ্ধির হার পূর্ব এশিয়ায় একেবারেই কম এবং বনাঞ্চলের প্রকৃত হ্রাস পরিলক্ষিত হয় দক্ষিন- পূর্ব ও দক্ষিন এশিয়ায়।
অর্থাৎ তথ্যসুত্র হতেও দেখতে পাচ্ছি যে, আবহাওয়ার বিরুপ পরিবর্তন ঠেকাতে, এর ভয়ংকর ক্ষতিকর রূপ হতে রক্ষা পেতে যে বনজ সম্পদের প্রয়োজন তাতেও আমরা পশ্চিমাদের চেয়ে পিছিয়ে আছি। আমরা আদোতে বুঝতে পারছি না যে, উন্নয়নের নামে আমরা মূলত ধবংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
আমরা এমন একটা অবস্থায় আছি এখন যেখানে প্রতিকার, প্রতিরোধ একসাথে প্রয়োগ করতে হবে। একদিকে যেমন আমাদের সবুজ সংরক্ষণ করতে হবে, বনাঞ্চল বাড়াতে হবে অন্যদিকে কালো ধোঁয়ার উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। জীবনযাত্রার প্রয়োজনে দালান-কোঠা, কল-কারখানা দরকার আছে কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য, টিকে থাকার জন্য সবুজায়নের বিকল্প নেই।
একটা সময় স্লোগান ছিলো "গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান" কিন্তু আমার এখন মনে হয় মানুষের নিজেকে বাঁচানো দায় হয়ে পড়েছে। তাই "গাছ লাগান, নিজেকে বাঁচান"।
এখনো হয়তো সময় আছে! কোন বড় ধরনের বিপর্যয়ের আগে আসুন সচেতন হই। কারণ এই অতিরিক্ত উষ্ণতা শুধু আমাদের গরমের কষ্ট দিবে না, এই অতিরিক্ত উষ্ণতার ফলে হবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঘূর্ণিঝড়, জ্বলোচ্ছাস, ভুমিধ্বস, ভুমিকম্প এগুলোর নিয়ন্ত্রন আমাদের হাতে নেই। আমরা কেবল এগুলো থেকে রক্ষা পেতে প্রস্তুত হতে পারি। আসুন সেই প্রস্তুতি নেই। আসুন বেশি করে গাছ লাগাই।
আমরা মানুষেরা পৃথিবীটাকে, প্রকৃতিটাকে এমন একটি চরম অস্বস্তিকর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছি যেখানে সমস্ত নিয়ামত এখন টাকা খরচ করে কিনে নিতে হয়। ঠান্ডা বাতাস, বিশুদ্ধ বাতাস, বিশুদ্ধ পানি এসব টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। অথচ এই প্রকৃতিতেই সমস্ত নিয়ামত ছিলো এবং আছে আমাদের জন্য। এসব হারিয়ে ফেলার আগে আসুন যত্ন নেয়া শুরু করি। আসুন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে একটি সবুজ নির্মল পৃথিবী তুলে দেই।
লেখক : শাহানা নাসরিন
প্রিন্সিপাল অফিসার, ঢাকা ব্যাংক