১০ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার | বাংলা কনভার্টার
মো.সাব্বির হাসান.মাঝে মধ্যে মাইলের পর মাইল পথ চলা। গাড়ির চাকা ঘুরলেই তেলের টাকা দিতে হয়। কিন্তু আমাদের জীবনের চাকা ঘুরলে কে দেয় টাকা? কত টাকা আমাদের বেতন? কিভাবে পাই আমরা আমাদের ন্যায্য দাবী টুকু? কে রাখে আমাদের খবর? অথচ আমাদের পথ ছুটে চলতে হয় গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। রোদ বৃষ্টি মাথার উপর বয়ে বেড়ায় একজন গ্রাম সাংবাদিক। পরের জমি,পরের গাড়ি,পরের বাড়ি, পরের সমাজ,এ দল ও দল ক্ষমতায়, জ্বালাও পোড়াও, পিটাও মারো, ক্যামেরা ভাংগো কেন এত বর্বরতা আমাদের উপর? এক বার কি দেখেছো আমাদের জীবনটা কত কষ্টের?
আজ বলছি তোমাদের সাথে আমাদের মিলাতে কতটা কষ্ট আর কতটা শ্রেয়হীন। সাদা পোশাকের কথা বলবো না। তোমাদের সাদা পোষাকটা আছে বলেই আমাদের হাতে বিধাতা ও দেশ মাতা দিয়েছেন কালো রংয়ের একটি কলম। হয়ত তোমার সাদা পোষাকে তোমার অসাদা মনের চিহ্ন দেওয়া বা তোমার বুকের সাদা জমিনে একটি জাগ্রত জম্মভূমির ইতি কথা লেখার জন্যে এ কলম। যাক সে কথা প্রতিদিন কত কথা লিখি তোমাদের জন্যে আজ না হয় আমরাই লিখবো আমাদের কথা। ছদ্মনামের একজন বিবেক। বিবেক নামের অর্থ একজন বিবেকবান ব্যক্তি, না অন্য কিছু জানিনা। স্বপ্ন বিবেকের সাংবাদিকতা। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সে।পরিবারের ইচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে সাংবাদিকতার পেশায় মনোযোগ দেয় সে। এইচ,এস,সি পাশ শেষ করে। স্নাতকে ভর্তি হয়। মাধ্যমিক এর স্বপ্ন যাত্রা স্নাতকের প্রথম বর্ষে বিবেক। কিভাবে পত্রিকার সাথে যুক্ত হবেন এ নিয়ে শুরু হয় সাংবাদিকতার গল্প। স্থানীয় কয়েকজন সংবাদকর্মীর সাথে পরিচয় হয় বিবেকের। নিজেকে তাদের সাথে নিতে বললে এ নিয়ে শুরু হয় রেষারেষি। সংবাদকর্মীরা তাদের সাথে নিতে অযুহাত দেখায়। এ নিয়ে সে মাস ছয়েক সময় পার করে। স্নাতকের প্রথম বর্ষ পার হয়। সাপ্তাহিক চাকুরীর খবরের কাগজে চোখ রাখে নিয়মিত। মাঝে মধ্যে কিছু টিউশনি করে সে। টিউশনি করা বিবেকের স্কুল জীবন থেকে। টিউশনের কিছু টাকা পরিবার কে দিতে হয়। কিছু টাকা নিজের পড়াশোনা ও সঞ্চয়ী হিসাবে পোষ্ট অফিসে একটি হিসাব খোলে। বেশ কয়েক বছরে হাজার তিনেক টাকা সঞ্চয় হয়েছে তার। বিবেক স্কুল জীবন থেকে টিউশনের সাথে জড়িত। একদিন সপ্তাহের চাকুরীর খবর নামের একটি পত্রিকায় “সংবাদদাতা আবশ্যক” নিয়োগ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞাপন পায়। ওই বিজ্ঞাপনে কোনো মোবাইল নাম্বার ছিলো না। শুধু অফিসের ঠিকানা ছাড়া। বিবেক একটি বায়োডাটা পাঠিয়ে দেয় কুরিয়ারে। ২০০৬/৭ সালের কথা। বিবেকের ঠিকানায় অফিস থেকে একটি চিঠি আসে। পত্রিকা অফিসের চিঠি দেখে বিবেকের খুব ভালো লাগে। সাংবাদিকতা নামের স্বপ্নটার আগ্রহ বাড়ে। বিবেক নিজেকে নির্জন এলাকায় নিয়ে যায়। এরপর বিকেলে ওই চিঠি খুলে। চিঠিটা পড়তে বিবেকের বেশ ভালো লাগেছে। কিছু উল্লেখ করলাম আপনাদের জন্য ওই চিঠির লেখা থেকে.......জনাব বিবেক...আপনার বায়োডাটা আমরা পেয়েছি। আপনি অবগত হবেন সাংবাদিকতা একটা মহৎ পেশা। এ পেশায় আপনাকে আসতে হলে অফিসের কিছু নিয়মনীতি মানতে হবে। পরের লাইন গুলো বিবেকের কাছে দুঃস্বপ্নের মত মনে হয়। সেখানে একটি মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া আছে। তিন হাজার টাকা দিতে হবে বিবেক কে। তাও কিনা ঢাকায় গিয়ে। টাকার বিনিময়ে ক্যামেরা, পরিচয়পত্র, বেতনভাতাসহ আরও অনেক সুবিধা পাবেন। চাকুরী নিতে বা দিতে হলে টাকা দিতে হয় বিবেক জেনেছে। কিন্তু আজ সে নিজেই বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। স্থানীয় দু’একজন ও এমন টাকার বিপরীতে সাংবাদিক হয়েছেন এটা বিবেক জেনেছে। ওইদিন বৃহস্পতিবার। দুই দিন পর রোববার পোষ্ট অফিস থেকে তার টিউশনি করে যোগানোর অর্থ থেকে তিন হাজার টাকা উত্তোলন করে। ওই সময় স্থানীয় এক সাংবাদিকের সাথে দেখা ও কথা হয় বিবেকের। তিনি বলেন এ তো নামহীন পত্রিকা। এর চেয়ে আরও ভালো পত্রিকার কার্ড নিয়ে আসা যাবে এ টাকায়। ওই সাংবাদিকের সাথে আলাপ হয় বিবেকের। এই প্রথম একজন তাকে এ পেশায় আসতে সাহায্য করছে মনে হলো তার। তাকে মোট পাঁচ হাজার টাকা দিলে মিলবে এর চেয়ে আরও ভালো সাংবাদিকতার কার্ড। বিবেক এরপর ওই সাংবাদিকের সাথে যোগ হয়। বিবেকের ঢাকার পথ তেমন পরিচিত নেই। জীবনে ক’বার গেছে কড়া গন্ডায় হিসাব কষকে পারবে। বিবেক নিজের এককপি রঙিন ছবি আর নগদ চার হাজার টাকা দিয়ে দেয়। সে ও একজন সাংবাদিক। বিবেক একদিকে যেমন সাংবাদিকতার কার্ড পেতে খুশি অপর দিকে বিষয়টি নিয়ে খটকা লাগে। টাকা দিয়ে সাংবাদিকতার চাকুরী? একমাস পর কার্ড হাতে পায়। অবশ্য বেশ কয়েকবার বিবেকের সাথে কার্ড দেওয়ার সময় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। কার্ড পাওয়া গেলেও পত্রিকা কিভাবে আসবে সেও বলে দেয়। চার হাজার টাকা কার্ড ও নিজ উপজেলায় পত্রিকা আসবে এ ব্যাপারে জামানত হিসাবে টাকা নেওয়া হয়েছে কার্ড দেওয়ার সময় বিবেক কে জানিয়ে দেয় ওই সাংবাদিক। বিবেক খুব সকালে উঠে উপজেলার পত্রিকা সরবারাহ জায়গায় যায়। বিবেকের পত্রিকা এসেছে। পত্রিকা অফিসের কারো সাথে তার যোগাযোগ নেই। পত্রিকা হাতে নেয়। তেমন কোনো পরিচিত পত্রিকা নয়। ঢাকার বাইরে মফস্বল এলাকায় ওই পত্রিকার বিচরণ খুব বেশী নেই।
বিবেকের হাতে পত্রিকা ও পকেটে সাংবাদিকতার কার্ড। বিবেক ব্যক্তি জীবনে একজন স্কাউট ছিলেন। সেই স্কাউটিং জীবনে পরের উপকারে কাজ করা এবং পূথিবী টা যেমন আছে এর চেয়ে একটু ভালো করে রেখে যাওয়া বিষয়টিতে অঙ্গীকার বদ্ধ। তার যাত্রা শুরু হলো। পড়াশোনার বাইরে এখন সংবাদের পিছনে ছুটে চলা। সমাজের নানা অনিয়ম আর অসংগতি এবার তার চোখে পড়ে। বিশেষ করে পরিবেশ ও সমাজের ক্ষতিকর বিষয়ের উপর তার মনোবেশ হয়। প্রথমে পিয়াজখালী বাজারের স্কুল শহীদ মিনার উদ্বোধণ নিয়ে মহান একুশে ফ্রেব্রুয়ারী নিয়ে একটি সংবাদ তৈরী হয়। ওই সংবাদ পত্রিকায় পাঠানো হলো। মেইল করতে একটি সংবাদ ৩০টাকা। নিউজ ছাপা হয় পরদিন পত্রিকায়। এভাবে পথ চলতে শুরু হয় তার। মাসের অর্ধেক সময় এসে হঠাৎ করে পত্রিকা বন্ধ করে দেয় অফিস। এই পনের দিনে কয়েক সংখ্যা পত্রিকা সে পেয়েছে। অফিসে যোগাযোগ করার মত তেমন কোনো নাম্বার নেই। পত্রিকার পেছনে সম্পাদকের মোবাইল নাম্বার দেওয়া রয়েছে। কিছুটা শঙ্কিত হয়ে ফোন দেয় সে। সম্পাদক ফোন তুলেন। আমি বিবেক সদরপুর ফরিদপুর প্রতিনিধি আপনার পত্রিকার। হ্যাঁ বলেন ওপাশ থেকে উত্তর আসে। আমি কয়েক দিন ধরে পত্রিকা পাচ্ছিনা? পত্রিকা ছাপা হচ্ছে না তাই। তাহলে কবে পাবো.......যোগাযোগ রাখেন পাবেন।
এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে যায় বিবেকের সাংবাদিকতার জীবন। এরপর সংবাদ পাঠানো,ছাপানো ও নিজ এলাকায় আনা নেওয়াসহ পুরোটাই চলে তার টিউশন করে আয় উৎসের অর্থ থেকে। শখ থেকে নেশা পেশায় জড়িয়ে পড়তে থাকে বিবেক। মাস শেষে ১৫’শ টাকা পত্রিকা অফিসে, সংবাদ ছাপানোর জন্যে টাকা ও বছরের উৎসব দিন গুলোতে বিজ্ঞাপন দিতে হয়। এভাবে বিবেকের একটা বছর চলে যায়। এক বছরে সে প্রায় ২০হাজার টাকা এই পেশায় শেষ করেছে। নিয়োগের সময় তাকে প্রতিমাসে বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও সেটা পায় নাই। উল্লেখ ছিলো মাসে ১৫’শ টাকা করে বেতন দিবে পত্রিকা অফিস। এতে এক বছরে সে ১৮হাজার টাকা পাওয়ার কথা ছিলো। উল্টো তাকে ওই অর্থ খরচ করতে হয়েছে। সৎ থাকা এবং সৎ হওয়া খালি হাতে কতটা? এলাকায় পত্রিকার নাম ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বিবেক ও একটু আটটু সাংবাদিক জপতে থাকে। নেশা থেকে পেশার দিকে বিবেক ছুটে পথে। গ্রাম সাংবাদিক এবার ঢাকার পথে বাড়ায় আরেকটি ভালো দৈনিকে কাজ করার জন্যে। এর কারন হিসাবে জানতে পারা যায়, তার চেয়েও বড় পত্রিকার প্রতিনিধি এলাকায় রয়েছে। বিধায় সমমূল্য হতে হলে তাকেও বড় পত্রিকায় কাজ করতে হবে। এক বছরে বিভিন্ন সংবাদ পরিবেশন করে এলাকার কিছু মহল থেকে সামান্য সম্মানী ও পেয়েছে সে।
একদিকে বিবেকের (বি.এ)পরীক্ষা অন্যদিকে পত্রিকার সংবাদ দুটো মিলে বড় হতাশায় পড়ে সে। বিবেক স্বিদ্ধান্ত নেয় আগে পরীক্ষা পরে সাংবাদিকতা। এরপর কিছুদিন পরীক্ষার জন্যে এই লাইন থেকে আলাদা হয়ে যায়। ওই সুযোগে এলাকার আরেকজন ওই পত্রিকায় যোগদান করেন। পরীক্ষা শেষ হলে নিজের পত্রিকায় অন্যজনের যোগদানে কিছুটা কষ্ট পায়। বিবেক তবুও পিছু হটেনা। সামনের দিকে এগিয়ে যেতে আবারও পথ চলতে শুরু করে। এ সময় বিবেকের কেবলই মনে মনে বলে শালা কাকের মাংস কাকে খায়...........................। বাকি অংশ আপনাদের জন্যে আগামী পর্বে।